৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ থেকে দেখা যাবে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ
- ০২:০৪
- ব্রেকিং নিউজ
- ৩০৫৪
রোববার, ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে। বিরল এই মহাজাগতিক ঘটনাটি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ থেকেও দেখা যাবে। প্রাচীণ মানুষদের কাছে গ্রহণের বিষয়টি যেমন ছিল এক বিস্ময়কর ঘটনা তেমনি তারা বিশ্বাস করত গ্রহণের ফলে ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, ভূমিকম্প, উল্কাপাত, জলোচ্ছ্বাস, মহামারীর মত কোনও না কোন দুর্যোগ আসবেই। বর্তমান সময়ে আমরা জানি কেন সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ ঘটে থাকে। একদিকে এর সাথে কোন দৈব বা অতিপ্রাকৃত ঘটনার যেমন যোগসাজশ নেই অন্যদিকে এই মহাজাগতিক ঘটনা আমাদের বিজ্ঞান মানসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখছে। বাংলাদেশ থেকে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ পর্যবেক্ষণের সময় হচ্ছে:
গ্রহণ সংযোগ
উপচ্ছায়ায় প্রবেশ: রাত ০৯:২৮:২১ (৭ সেপ্টেম্বর)
প্রচ্ছায়ায় প্রবেশ: রাত ১০:২৭:০২
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ শুরু: রাত ১১:৩০:৪১
কেন্দ্রীয় গ্রহণ (সর্বোচ্চ): রাত ১২:১১:৪৩ (৮ সেপ্টেম্বর)
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ থেকে নির্গমন: রাত ১২:৫২:৪৭
প্রচ্ছায়া থেকে নির্গমন: রাত ০১:৫৬:২৬
উপচ্ছায়া থেকে নির্গমন: রাত ০২:৫৫:০০
গ্রহণের সময়কাল
উপচ্ছায়া সময: ৫ ঘন্টা ২৬ মিনিটি ৪০ সেকেন্ড
প্রচ্ছায়া সময়: ৩ ঘন্টা ২৯ মিনিটি ২৪ সেকেন্ড
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ সময়: ১ ঘন্টা ২২ মিনিট ৬ সেকেন্ড
চন্দ্রগ্রহণ কি
পৃথিবী উপবৃত্তাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণরত, মহাকাশে এই কক্ষপথ ক্রান্তিবৃত্ত (Ecliptic) নামে পরিচিত। তেমনি চাঁদও উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত। চাঁদের কক্ষপথ ক্রান্তিবৃত্তকে দুটি বিন্দুতে ছেদ করে। ছেদ বিন্দুকে পাত (Node) বলা হয়। যে ছেদ বিন্দুর মধ্যে দিয়ে চাঁদ দক্ষিণ থেকে উত্তরে যায় তাকে আরোহী পাত (Ascending Node) বলে এবং যে ছেদ বিন্দুর মধ্যে দিয়ে চাঁদ পুনরায় উত্তর থেকে দক্ষিণে যায় তাকে অবরোহী পাত (Descending Node) বলে। প্রতি মাসে চাঁদ দুইবার এই ক্রান্তিবৃত্ত অতিক্রম করে।
কক্ষপথ পরিভ্রমনের এক পর্যায়ে চাঁদ পৃথিবীকে মাঝখানে রেখে সূর্যের সাথে এক সমতলে এবং এক সরলরেখায় চলে এলে সূর্যের আলো পৃথিবীতে বাঁধা পড়ে চাঁদে পৌঁছতে পারে না। তখনই ঘটে থাকে চন্দ্রগ্রহণ। প্রতি পূর্ণিমাতেই চাঁদ পৃথিবীকে মাঝখানে রেখে সূর্যের বিপরীতে অবস্থান করে। কিন্তু প্রতি পূর্ণিমাতেই চন্দ্রগ্রহণ ঘটে না। কারণ, চন্দ্রগ্রহণ ঘটতে হলে চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবীকে অবশ্যই একই সরলরেখায় ও একই সমতলে থাকতে হবে। চাঁদের কক্ষতল পৃথিবীর কক্ষতলের সাথে গড়ে ৫ ডিগ্রী ৯ মিনিট কোনে অবস্থান করে। ফলে প্রতি পূর্ণিমাতেই চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবী একই সমতলে থাকলেও একই সরলরেখায় আসতে পারে না।
চন্দ্রগ্রহণের প্রকারভেদ
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ (Total lunar eclipse)
চাঁদ যখন পৃথিবীর প্রচ্ছায়ায় পুরোপুরি অবস্থান করে তখন পূর্ণ গ্রহণ ঘটে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর ছায়া দুই রকম হয়: প্রচ্ছায়া এবং উপচ্ছায়া। প্রচ্ছায়া অঞ্চলে সূর্যের আলো একদমই পৌঁছতে পারে না কিন্তু উপচ্ছায়া অঞ্চলে সূর্যের আলো কিছু পরিমাণ পৌঁছায়। চাঁদ যখন শুধুমাত্র উপচ্ছায়ায় অবস্থান করে তখন কোন গ্রহণ ঘটে না, চাঁদকে শুধু কিছুটা ম্লান দেখায়। পূর্ণ গ্রহণ শুরু হওয়ার আগের মুহুর্তে আংশিক গ্রহণ হতে থাকে এবং এক সময় পূর্ণ গ্রহণ শুরু হয় যখন চাঁদ প্রচ্ছায়ায় প্রবেশ করতে শুরু করে। চাঁদ যতক্ষণ প্রচ্ছায়ায় থাকে ততক্ষণ ঘটে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ। নির্দিষ্ট সময় পরে পৃথিবীর প্রচ্ছায়া থেকে চাঁদ ধীরে ধীরে বের হতে শুরু করলে আবার শুরু হয় চাঁদের আংশিক গ্রহণ। অর্থাৎ চাঁদের আংশিক গ্রহণ দিয়ে গ্রহণ শুরু এবং পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের দশা পেরিয়ে আবার তা আংশিক গ্রহণে ফিরে আসে।
প্রচ্ছায়ার আকৃতি কোনের মত, যা এক সময় একটি বিন্দুতে শেষ হয়। এটি প্রচ্ছায়া-কোনের শীর্ষবিন্দু (Apex)। পৃথিবীর আকার চাঁদের তুলনায় অনেক বড় হওয়ায় পৃথিবীর ছায়াও তুলনামূলক বড় হয়। একারণে পৃথিবীর প্রচ্ছায়া অঞ্চলের ব্যাসও অনেক বড় হয়। তাই পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ অনেক সময় ধরে দেখা সম্ভব। কিন্তু সূর্যগ্রহণের বেলায় এর ঠিক উল্টো ঘটে বলে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ খুবই অল্প সময়ের জন্য দেখা যায়। চন্দ্রগ্রহণের সমস্ত দশা প্রায় চার ঘন্টা ধরে চলে। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ সর্বোচ্চ ১ ঘন্টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলে পূর্ণিমা থাকে সেখান থেকেই চন্দ্রগ্রহণ দেখা যায়।
আংশিক চন্দ্রগ্রহণ (Partial lunar eclipse)
সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদের অসম্পূর্ণ সারিবদ্ধতার কারণে যখন চাঁদ পৃথিবীর প্রচ্ছায়ায় সম্পূর্ণ অবস্থান না করে কিছু অংশ উপচ্ছায়ায় থাকে তখন আংশিক গ্রহণ ঘটে।
উপচ্ছায়া গ্রহণ (Penumbral eclipse)
এটি প্রকৃত গ্রহণের মতো নয় বলে আপনার চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। এই সময় চাঁদ পৃথিবীর উপচ্ছায়ার মধ্যে দিয়ে যায়। চাঁদ এতটাই সামান্য ম্লান হয়ে যায় যে এটি সহজে চোখে পড়ে না।
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণে তামাটে রঙের চাঁদ
গ্রহণ চলাকালীন সূর্যগ্রহণের মতো চাঁদ পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় না। বরং আমাদের চোখে চাঁদকে দেখা যায় এক অদ্ভুত লালচে রঙে। অনেকেই ভাবেন, চাঁদ কি নিজেই রঙ বদলায়? আসলে তা নয়। এর পেছনে রয়েছে আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং সূর্যালোকের বৈশিষ্ট্য।
সূর্যের আলো নানা রঙের মিশ্রণ। প্রতিটি রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা। নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট, আর লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড়। যখন সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হওয়ায় এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কণার দ্বারা খুব সহজে বিচ্ছুরিত হয়। যখন সূর্য আমাদের মাথার উপর থাকে, তখন আমরা পুরো আকাশ জুড়ে নীল আলো দেখতে পাই।
অন্যদিকে, সূর্যোদয়ের বা সূর্যাস্তের সময় সূর্যালোককে আমাদের চোখে পৌঁছানোর আগে বায়ুমণ্ডলের আরও বেশি স্তর ভেদ করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। সূর্যের নীল আলো তখন ছড়িয়ে পড়ে এবং অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল, কমলা ও হলুদ আলো আমাদের কাছে পৌঁছায়। এজন্য সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয়ের সময় আকাশ লালচে বা কমলা রঙের হয়ে ওঠে।
চন্দ্রগ্রহণে ঘটে ঠিক এ রকমই একটি ঘটনা। পৃথিবী সূর্য আর চাঁদের মাঝখানে চলে আসে, ফলে সূর্যের আলো সরাসরি চাঁদে পৌঁছাতে পারে না। পৃথিবীর চারপাশের বায়ুমণ্ডল দিয়ে আলো প্রতিসরিত ও বিচ্ছুরিত হয়ে চাঁদে পৌঁছায়। এই সময়ে নীল আলো ছড়িয়ে যায়, আর লাল আলো অপেক্ষাকৃত সহজে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে চাঁদের গায়ে পড়ে। এজন্য গ্রহণকালে চাঁদ লালচে বা তামাটে রঙের দেখা যায়। যায়। গ্রহণের সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যত বেশি ধুলো বা মেঘ থাকে, চাঁদ তত বেশি লাল দেখায়। তবে পৃথিবীর নিজস্ব বায়ুমন্ডল না থাকলে চাঁদকে কালোই দেখাতো।
চন্দ্রগ্রহণের ঐতিহাসিক ঘটনা
১৫০৪ সালের শুরুর দিকে কলম্বাসের তার চতুর্থ সমুদ্রযাত্রায় দক্ষিণ আমেরিকার জ্যমাইকা উপকূলে অবস’ানের এক পর্যায়ে স্থানীয় আদিবাসীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। মুখোমুখি হন তীব্র খাদ্য ও পানীয় সংকটের। ঐ মুহুর্তে উত্তরণের কোন পথ খুঁজে না পেলেও পাচ্ছিলেন নিজেকে সহ জাহাজের সকল নাবিকের বেঘোরে প্রাণ খোয়ানোর ইঙ্গিত। কলম্বাসের কাছে তখন ছিল সমসাময়িক জার্মান গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ রেগিওমন্টেনাস্ তৈরিকৃত চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণের তালিকা সহ একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানপঞ্জি। সেখানে কলম্বাস দেখতে পান ১৫০৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি, বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় ঘটতে যাচ্ছে একটি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ। এই মহাজাগতিক ঘটনাকেই তিনি স্থানীয় আদিবাসীদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তাদেরকে ভয় দেখান যে যদি তারা তাদের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ না করেন তবে ঈশ্বর তাদের প্রতি রুষ্ট হবেন আর তাদের উপর নেমে আসবে চির অন্ধকার! এভাবে চন্দ্রগ্রহণের বদৌলতে সেইবার তারা সকলে মুক্তি পান।
গ্রহণ ঘেরা কুসংস্কার
প্রাচীণ মানুষদের কাছে গ্রহণ মানেই ছিল দেবতাদের অভিশাপ। বর্তমান সময়েও দেখতে পাওয়া যায় গ্রহণ চলাকালীন সময়ে খাবার গ্রহণ না করা, বাইরে বের না হওয়া, গর্ভবতী মহিলাদের বিভিন্ন বিধিনিষেধ মেনে চলা প্রভৃতি। কিন্তু গ্রহণের সাথে এসবের কোন সম্পর্ক নেই। এটি প্রকৃতির এক নিয়মের আওতায় ঘটে চলা স্বাভাবিক ঘটনা। জোয়ার-ভাঁটার পরিবর্তন ছাড়া এর অন্য কোন প্রভাব নেই। কাজেই সব রকম অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার ত্যাগ করুন।
চন্দ্রগ্রহণ পর্যবেক্ষণ
চন্দ্রগ্রহণ এমন একটি মহাজাগতিক ঘটনা, যা যে কেউ একেবারেই নিরাপদে খালি চোখে দেখতে পারেন। কোনো বিশেষ চশমা বা যন্ত্রের প্রয়োজন নেই। যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে, তাহলে গ্রহণের প্রতিটি ধাপ খালি চোখে পর্যবেক্ষণ করা যায়। দেখতে পাবেন কিভাবে চাঁদের এক কোণে ধীরে ধীরে ছায়া পড়ছে, তারপর চাঁদ ক্রমশ অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে, আবার ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হয়ে উঠছে। আরও সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে দূরবীন বা টেলিস্কোপ ব্যবহার করা যেতে পারে। তাতে চাঁদের পৃষ্ঠে ছায়ার অগ্রগতি এবং রঙের পরিবর্তন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে চোখে ধরা দেবে।
চন্দ্রগ্রহণের মতো মহাজাগতিক ঘটনা শুধু বিস্ময়ের জন্মই দেয় না, এগুলো আমাদের বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তুলতেও সহায়ক। এ ধরনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ আমাদের বিজ্ঞানের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ঘটায়। একই সঙ্গে মহাজাগতিক ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা একটি বিশাল মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র অংশ। এর মাধ্যমে মানুষ মহাবিশ্বকে আরও বাস্তব ও স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারে।