সাবর্ণ সংগ্রহশালার প্রদর্শনী ও বাংলাদেশ

সাবর্ণ সংগ্রহশালা
কলকাতার ইতিহাসের সাথে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের একটি গভীরতর যোগসূত্র রয়েছে । সেই ঐতিহাসিকতা ও নিজস্ব সংস্কৃতির ঔজ্জ্বল্যকে তুলে ধরার প্রয়াসে তাঁরা বড়িশার বড়বাড়িতে গড়ে তুলেছেন একটি চমৎকার সংগ্রহশালা ও জাদুঘর । এটি একটি গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থা হিসেবেও কাজ করছে । প্রতি বছর কোলকাতায় বসে এর প্রদর্শনী । এই পরিবারের উত্থান পতনের নানান চিত্র এখানে সংগৃহীত নানান জিনিসপত্রের মাধ্যমে আগ্রহীরা পাবেন । এই পরিবারটি যেহেতু তৎকালীন কলকাতা এবং বঙ্গদেশের সাথে নানাভাবে যুক্ত সেহেতু এ প্রদর্শনীর সাথে বাংলাদেশেরও সম্পর্ক রয়েছে ।

সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাংলার একটি ঐতিহাসিক জমিদার পরিবার । ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে এই পরিবার ছিল কলকাতার জমিদার । ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর সুতানুটি, কলিকাতা ও গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটির সত্ত্ব বার্ষিক ১,৩০০ টাকা রাজস্বের বিনিময়ে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকে ইজারা নেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । চুক্তিপত্রটি ফারসি ভাষায় লেখা হয়েছিল । এর একটি নকল সাবর্ণ সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে । এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জিয়া গঙ্গোপাধ্যায় পরবর্তীকালে সন্ত কামদেব ব্রহ্মচারী নামে পরিচিত হন । তাঁর পুত্র লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় (মজুমদার) ১৬০৮ সালে রাজা মানসিংহের কাছ থেকে এক বিরাট ভূসম্পত্তি জায়গির হিসেবে অর্জন করেন ।

ইতিপূর্বে মুঘল সম্রাট আকবর তাঁদের ‘রায়’ ও জাহাঙ্গির তাদের ‘চৌধুরী’ উপাধি দিয়েছিলেন। এইরূপে ক্রমে ‘রায় চৌধুরী’ তাঁদের পদবিতে পরিণত হয়। লক্ষ্মীকান্ত হালিশহরে একাধিক মন্দির এবং গোঘাট ও আমাতিয়ায় পারিবারিক বসতবাটী নির্মাণ করেন । শোনা যায়, হালিশহর থেকে বড়িশা পর্যন্ত একটি তীর্থপথও তিনি নির্মাণ করেছিলেন । তার বংশধররা, যাদের সংখ্যা এখন প্রায় কুড়ি হাজার, যারা কলকাতা ছাড়াও হালিশহর, উত্তরপাড়া, মেদিনীপুর, বিরাটি, নিমতা, পাটনা, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালুর, নিউইয়র্ক, লন্ডন ইত্যাদি জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন, তাঁরা সাবর্ণ চৌধুরী বা সাবর্ণ রায়চৌধুরী অভিধায় পরিচিত হলেও, লক্ষ্মীকারন্তর পূর্বজদের কিন্তু সাবর্ণ চৌধুরী বা সাবর্ণ রায়চৌধুরী বলা হতো না । লক্ষ্মীকান্তের যখন আটত্রিশ বছর বয়স, তখন থেকে তাঁকে এবং তাঁর ছেলেদের সাবর্ণ চৌধুরী বলা আরম্ভ হয়।

একটি বিষয় আমাদের বাংলাদেশের মানুষদের বিশেষভাবে ভালো লাগবে জেনে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের পৌত্র আজিম-উস-শানের হুকুমে ১০ নভেম্বর ১৬৯৮ সালে যখন সাবর্ণ চৌধুরীদের কলকাতা, সুতানুটি, গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটির প্রজাস্বত্ত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হলো, তখন থেকে লক্ষ্মিকান্তের বংশধররা আর্থিক দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়ে বাধ্য হলেন ভিন্ন জীবিকার সন্ধানে বঙ্গদেশ ও ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়তে কিন্তু হস্তান্তরের সময়ে, এতবড় বিপদের মুখেও, তাঁরা ফারসি দলিলটিতে বঙ্গদেশকে জন্নত অর্থাৎ স্বর্গ বলতে ভোলেননি । জগৎশেঠ, রাজা মহেন্দ্র, রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, দুর্লভরাম, গঙ্গারাম ঠাকুর, নকুড়চন্দ্র সরকার, গোবিন্দরাম, রঘুমিত্র, শোভারাম বসাক, শুকদেব মল্লিক, দয়ারাম বসু, হরিকৃষ্ণ ঠাকুর, দুর্গারাম দত্ত, চৈতন্য দাস, দুর্লভচরণ বসাক, চূড়ামণি বিশ্বাস, রাজারাম পালিত, নীলমণি চৌধুরী প্রমুখ হিন্দু ভূস্বামী আর বণিকরা যখন সিরাজদৌলার বিরুদ্ধে দল বেঁধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সাহায্য করা আরম্ভ করেছিলেন, তখনও সাবর্ণ চৌধুরীরা নবাবের পক্ষ ত্যাগ করতে পারেননি । বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনুভূতি ও ইতিহাস-দর্শনের সমান্তরাল এই আচরণ । ফলে ইংরেজরা সাবর্ণ চৌধুরীদের আর দাঁড়াতে দেয়নি।

২০০১ সালে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার পরিষদের পক্ষ থেকে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে দাবি করা হয় যে, জব চার্নক সত্যই কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা কিনা তা খতিয়ে দেখা হোক । হাইকোর্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০০৩ সালের ১৬ মে রায় দেন যে, জব চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা নন এবং ২৪ আগস্ট ( যে তারিখটিতে জব চার্নক সুতানুটিতে উপনীত হয়েছিলেন ) কলকাতার জন্মদিনও নয় । এর ফলে কলকাতার প্রকৃত ইতিহাস উদ্ঘাটিত ও পুনর্লিখিত হয়েছে।

এই পরিবারের অন্যতম ঐতিহ্য হাতে-লেখা পত্রিকা ‘সপ্তর্ষী’। ২৫ বছরেরও অধিককাল হাতে-লেখা একটি পত্রিকার টিকে থাকা অভূতপূর্ব বলা যায় । সে হিসেবে এটি ঐতিহাসিক ও অত্যন্ত গৌরবের । সাবর্ণ সংগ্রহশালার প্রদর্শনীর মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা প্রায় বিশ-বাইশ হাজার সদস্যের একটি পরিবারের অতীত গৌরব ও ঐতিহ্যের দিকগুলি তুলে ধরে নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অনুভূতি জাগ্রত করা।

সাবর্ণ সংগ্রহশালা নামে একটি মিউজিয়াম-ও খোলা হয়েছে, যেখানে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের স্মৃতিজড়িত প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করা হচ্ছে। ঠিকানা: সপ্তর্ষি ভবন, বড় বাড়ি, বড়িশা, কলকাতা ৭০০০০৮।

- ইশরাত জাহান ইউনিটি, সম্পাদক, সম্পর্ষী (২০১৫)